home about

Click on the names!

গ্রহান্তরের ভালোবাসা

প্রফেসর ম্যাক্সওয়েল জানালার কাছে এসে দাড়ালেন। নিজের অজান্তেই তার বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তার চোখের সামনে পৃথিবীটা একটু একটু করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। টিভি চালু করে ম্যাক্স বিশ্বযুদ্ধের কারন জানার চেষ্টা করলেন। খবরে যা বোঝা গেলো তা মোটামুটি এই - আমেরিকা ও চীন এটা শুরু করেছে। আমেরিকার একটা ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষার সময় দুর্ঘটনাবশত তা বেইজিংয়ে গিয়ে পড়ে। ভয়াবহ বিস্ফোরণে মারা যায় প্রায় ৭ কোটি মানুষ। চীন আমেরিকাকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত থাকলেও কিছু চীনা বিজ্ঞানী যারা আমেরিকায় কর্মরত ছিলো, পারমানবিক চুল্লীতে ত্রুটি করে দেয়। ফলস্বরূপ ঘটে পারমানবিক বিস্ফোরণ। এরপর আমেরিকা চীনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করে, অনিবার্যভাবেই অন্য দেশরাও জড়িয়ে পরে এতে। ম্যাক্সের চিন্তা তার ভাইপোকে নিয়ে। তাই ভাইপো শার্লট পাশের শহরের ধ্বংসস্তূপে ফাইল খুঁজতে গিয়েছে। বিজ্ঞানী চুয়ান গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। তিন বছর ধরে যোগাযোগ বজায় রাখা এলিয়েনটি মাত্রই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করেছে। কিন্তু প্রবেশ করা মাত্রই সম্ভবত এলিয়েনের রাডার নষ্ট হয়ে গেছে কারন এলিয়েনটা আর কোনো সিগন্যাল পাঠাচ্ছেও না, রিসিভও করছে না। অবশ্য চুয়ান জানেন প্রানীটা যথেষ্ট উন্নত এবং তার বাসাকে ডিটেক্ট করে জায়গামত ফিরে আসতে পারবে। শুধু অন্য কারো হাতে না পড়লেই হয়। অনেকক্ষণ খোজাখুজির পর শার্লট ওর প্রাক্তন বাসার ধ্বংসস্তূপ থেকে কাঙ্ক্ষিত ফাইলটা উদ্ধার করতে পেরেছে। হাতে নেয়া মাত্রই হঠাৎ মাথার উপরে বিকট শব্দ শুনতে পেলো। প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় সে তৎক্ষনাৎ দিলো লাফ। পিছনে তাকিয়ে শার্লট দেখতে পায় বিশাল এক মহাকাশযান। উজ্জ্বল কোনো পদার্থে তৈরি, উপবৃত্তাকার এবং মূল অংশ থেকে চারটি পায়া বের হয়ে ধ্বংসস্তূপে দাড়িয়ে আছে। নিরীক্ষণ করত করতেই মহাকাশযানের একটা দরজার মতো খুলো গেলো। সেখান দিয়ে বেরিয়ে এলো একটা এলিয়েন। শার্লট অবাক হয়ে এলিয়েনটার দিকে চেয়ে আছে। এলিয়েনটা দৈর্ঘ্যে মানুষেরই সমান, কিন্তু পা আছে চারটা আর মাথা মানুষের চেয়ে বড়। হাত আছে দুটো। মাথায় আবার চারদিকে চারটা চোখ, গায়ের রং অবশ্য নীল। এমন একটা অদ্ভুত প্রানী দেখলে অন্যরা ভিরমি খেতো কিন্তু শার্লট যথেষ্ট সাহসী। হঠাৎ শার্লট বুঝতে পারলো প্রানীটা তাকে কিছু বলছে, কিন্তু তার মুখ নড়ছে না। সরাসরি মনের মধ্যেই সে কথাগুলো শুনতে পেলোঃ আমি যদি ভুল না করে থাকি তবে তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো। তুমি পৃথিবীর অধিবাসী শার্লট এবং তোমার সম্বন্ধে তথ্য আমি তোমার স্মৃতিকেন্দ্র হতে সংগ্রহ করেছি এবং তোমার ভাষাও এভাবেই বলতে পারতেছি। আমি হলাম স্প্রিন্স সুদূর এপসিলন এরডানি নক্ষত্রমন্ডল থেকে তোমাদের গ্রহে এসেছি। আশাকরি আমায় ভয় পাবে না। তোমার কোনো প্রশ্ন আছে? শার্লট বুঝতে পারলো আসলেই প্রানীটা উন্নত নাহলে মনের মধ্যে কথা বলা/স্মৃতি পড়া এগুলো সম্ভব হতো না। তাই সে প্রানীটার কথাগুলোয় দ্বিমত না করে বললো- হাই স্প্রিন্স, আমাদের পৃথিবীতে তোমায় স্বাগতম। স্প্রিন্স শার্লটের মনের মধ্যে প্রশ্ন তুললো- এই ধ্বংসস্তূপ কিসের?পারমানবিক তেজস্ক্রিয়তা ডিটেক্ট করে আমি এখানে নামলাম। কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে নাকি পৃথিবীতে? শার্লট উত্তর দিলো- হ্যা, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমানবিক বোমার কারনে ধুলিস্যাৎ হয় গিয়েছে আমার এ শহর। স্প্রিন্স এবার কারন জানতে চাইলে শার্লট তাকে ওগুলোরও উত্তর দিলো। কিছুক্ষণ কথার পরে স্প্রিন্স তাকে নিজের মহাকাশযানে আমন্ত্রণ জানায়। শার্লট তো মহাখুশি, ছোটবেলা থেকেই এলিয়েন আর ইউএফও নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ তার। এমন সুযোগ আর হাতছাড়া করলো না, টুপ করে স্পেসশিপটায় উঠে পড়লো। স্পেসশিপেটার ভিতরটুকু আসলে বিশাল বড় স্টেডিয়ামের মতো। শার্লট বুঝতে পারলো এই স্প্রিন্স চতুর্মাত্রায়ও জয় করেছে এবং স্থানকাল সংকোচনের মাধ্যমে বিশাল জায়গাকে ছোট্ট স্পেসশিপে মার্জ করে দিয়েছে। কন্ট্রোল প্যানেলের মতো একটা অংশে স্প্রিন্স কিছু বোতাম টিপলো আর মহাকাশযানটা আবার উড়াল দিলো আকাশে। শার্লট জানতে চাইলো স্পিন্স কি পৃথিবী আবিষ্কার করেছে নাকি পৃথিবীর কেউ তাকে নিমন্ত্রণ করেছে। উত্তরে স্প্রিন্স জানায় সে চুয়ানের আমন্ত্রণে পৃথিবীতে এসেছে আর এখন চুয়ানের উদ্দেশ্যই চলছে। শার্লটের সন্দেহ হয়। বছর তিনেক আগে এক বিজ্ঞানী যার নাম চুয়ান, জেল থেকে পালিয়ে যায়। পরে তার কোনো খোজ পাওয়া যায়নি। এই চুয়ানই সেই চুয়ান নয়তো?স্প্রিন্সকে দিয়ে কি করবে চুয়ান? চিন্তার সাথে সাথেই স্প্রিন্স শার্লটকে উত্তর দিলো, "চুয়ান আমাকে দিয়ে কিছু করতে পারবে না। আমি এসেছি মানবজাতিকে সাহায্য করতে আর সেটাই করে যাবো। তবে আগে দেখি চুয়ান কি বলে।" কিছুক্ষণের মধ্যেই চুয়ানের বাসায় সামনে খোলা মাঠে ল্যান্ড করলো স্পেসশীপ। শার্লটকে স্পেসশীপে রেখে স্প্রিন্স চুয়ানের সাথে দেখা করতে গেলো। শার্লটের সামনে মনিটরে স্প্রিন্স আর চুয়ানের কথোপকথন ভেসে উঠে। -পৃথিবীতে স্বাগতম স্প্রিন্স -ধন্যবাদ -শোনো স্প্রিন্স তুমি যেহেতু মানবজাতিকে সাহায্য করতে এসেছো তোমার কিছু প্রযুক্তি আমায় দেও। আমি তোমার প্রযুক্তি ব্যবহার করে পৃথিবীকে সুন্দর করে তুলবো। -তুমি মিথ্যা বলছো চুয়ান। তুমি হয়তো বুঝতেও পারোনি আমি তোমার চিন্তাগুলোর মধ্যে কথা বলছি, তাই তোমার সব চিন্তাই আমার জানা। তুমি আমার প্রযুক্তি দিয়ে বিশ্বযুদ্ধে চীনকে জয়ী করার পরিকল্পনায় আছো। আমি খুব অসন্তুষ্ট হলাম। বিদায়। -এতো সহজে আমার ৩ বছরের পরিশ্রম বৃথা যেতে দেবোনা। নিজের দেশের জয় চাওয়া কি অন্যায়? হাতের কাছে একটা সুইচ টিপে দিলো চুয়ান। হঠাৎ শার্লট স্ক্রিনে দেখতে পেলো উপর থেকে একটা খাঁচা নেমে স্প্রিন্স কে বন্দি করে ফেলেছে। স্প্রিন্সের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় অন্ধকার নেমে এলো স্পেসশিপের স্ক্রিনে। -দেশের জয় চাইতে গিয়ে মানবজাতির অস্তিত্ব সংকটাপন্ন করছো তুমি। আমাকে আটকেছো কেন এভাবে? - তোমায় আটকে না রাখলে তোমার প্রযুক্তি পাবো কিভাবে?তুমি এখানেই থাকো, আমি স্পেসশীপটা একটু ঘুরে আসি। কারো আসার শব্দ পেয়ে একটা টেবিলের মতো বস্তুর নিচে লুকিয়ে পড়লো শার্লট কারন স্প্রিন্সের চারপায়ে হাটা নিঃশব্দ অতএব ওটা স্প্রিন্স নয়। শিস বাজাতে বাজাতে কন্ট্রোল প্যানেলের কাছাকাছি আসছে চুয়ান। একমুহূর্তে পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেললো শার্লট। চুয়ান যখন কন্ট্রোল প্যানেলের বাটনগুলো বোঝার চেষ্টায় মগ্ন, শার্লট ততক্ষণে চুয়ানের পিছনে এসে মাথায় আঘাত করে দিয়েছে। পারফেক্ট আঘাতের কারনে চুয়ান তৎক্ষনাৎ অজ্ঞান। এবার শার্লট চুয়ানের বাসায় ঢুকলো। স্প্রিন্সকে খুঁজে পাওয়া মাত্রই স্প্রিন্স শার্লটকে বলে দেয় সুইচের অবস্থান। সেটায় টিপ দিতেই মুক্ত হয়ে যায় স্প্রিন্স। দুজনে আবার স্পেসশীপে ফিরে আসে। স্প্রিন্স বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে শার্লটের প্রতি। -তুমি না থাকলে আমার যে কি হতো!কিভাবে তোমায় ধন্যবাদ দিবো বুঝতে পারছি না। -পৃথিবীটাকে আগের মতো করে দেও, আর কিছুই চাই না। -এটাই তোমার একমাত্র ইচ্ছা? -হ্যাঁ। -বেশ! কন্ট্রোল প্যানেলে মনোযোগী হয় স্প্রিন্স। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করে, -ন্যূনতম কত সময় আগে পৃথিবী সম্পূর্ণ ঠিকঠাক ছিলো? -৬ মাস। -ঠিক আছে। আমি পৃথিবীকে ঠিক ৬ মাস আগের মতো করে দিয়ে যাচ্ছি। -এটা কিভাবে করবে? -চতুর্মাত্রিক প্রযুক্তি দিয়ে অতীতের পৃথিবী থেকে ঠিকঠাক অংশগুলো কপি করে এনে তার দ্বারা ধ্বংস হয়ে যাওয়া অংশগুলো প্রতিস্থাপন করে দিবো আর অবশিষ্ট নিউক্লিয়ার বোমাগুলোকে পারমানবিক চুল্লিতে রুপান্তর করে দিবো যেনো তোমরা শক্তির অভাবে না পড়ো। সবার মস্তিষ্কের নিউরন থেকে যুদ্ধের ভয়ংকর স্মৃতিটুকুও মুছে দিচ্ছি। যারা যুদ্ধ চালাচ্ছে তারাও থেমে যাবে। একটা শেষ সুইচ টিপে দিলো স্প্রিন্স। চারপাশ থেকে শোনা যেতে লাগলো পাখির ডাক! স্পেসশীপ থেকে বেরিয়ে দেখতে লাগলো শার্লট।দরজায় দাড়ানো স্প্রিন্স বললোঃ -এবার আমি আসি শার্লট। মানবজাতির জন্য অজস্র শুভকামনা। স্পেসশীপটা মিলিয়ে গেলো মহাকাশে। গ্রহান্তরের জীবের ভালোবাসায় ভিজে উঠলো শার্লটের চোখ!

অন্ধকারের বিভীষিকা

অন্ধকারের মাঝে হঠাৎই জ্বলে উঠলো দুটি সবুজ চোখ। ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে এল আদনান। প্রতিদিনই সন্ধ্যায় এই রাস্তা দিয়ে তার পথচলা। কিন্তু চিরপরিচিত পথে আজ এ কোন বিভীষিকা? ধীরে ধীরে অন্ধকার থেকে সম্পূর্ণ দৃশ্যমান হল জীবটি। ভয়ংকর রূপ সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারালো সে। সুমাইয়া নিজের বাড়ির উঠোনে খেলছিল। তার সঙ্গীদের সাথে গোল্লাছুট যখন মাঝামাঝি পর্যাপ্ত তখন আকাশ থেকে কিসের যেন ছায়া পড়ল। সবাই আকাশে তাকিয়ে দেখে ড্রাগনের মত বিশাল কিছু উড়ে যাচ্ছে। তারা তৎক্ষনাৎ চিৎকার করে উঠল। বাড়ির লোকজন বের হয়েও প্রাণীটাকে দেখল কিন্তু চিনতে পারল না কেউই। বাংলাদেশে বেশ কয়েকদিন ধরে অজানা একটি প্রাণীর আনাগোনা চলছে। যারা প্রাণীটাকে সম্পূর্ণ দেখে তারা নিশ্চিতভাবে অজ্ঞান হয়ে যায়। এ ঘটনায় সারা বিশ্বে তোলাপাড়। আমেরিকা থেকে নাসার লোকজন বাংলাদেশে আসবে বলে শোনা যাচ্ছে। এ পর্যন্ত খবর শুনে টিভি অফ করে দিলো রোদ। তার কাছে এসবই গুজব মনে হয়। তার ধারণা, এসব কয়েকজনের দৃষ্টিভ্রম এবং মিডিয়ার তিলকে তাল করা প্রচার। গোয়েন্দা হওয়ায় এরকম বহু গুজব সে আগেও দেখেছে। এরকম একটা প্রাণী আছে অথচ মানুষের কোনো ক্ষতি করছে না- এটা ভাবতেই হাস্যকর লাগে রোদের। ইনস্পেকটর অয়ন অবাক দৃষ্টিতে লাশটির দিকে চেয়ে আছেন। কোনো স্বাভাবিক মানুষ এত নৃশংস হতে পারে! সমস্ত শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন। বোঝা যাচ্ছে কোনো হিংস্র প্রাণিএমনটা করেনি। কারণ, সেক্ষেত্রে মানুষটির শরীরে মাংস থাকতো না। তিনি কনস্টেবলদের আদেশ দিলেন লাশ মর্গে স্থানান্তরের জন্য। মৃতদেহ দেখে বিস্ময়ের সীমা রইলো না ইন্সপেক্টর অয়নের। এটা ঠিক গতকালের মৃতদেহের মতো। এটাও তিনি মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। এরপর থেকে প্রতিদিনই এমন খুনের খবর আসতে লাগলো। বাংলাদেশে প্রতিদিন যথেষ্ট মৃত্যু হয়। একটির সাথে আরেকটির সাদৃশ্য করা দূরুহ ব্যাপার। কিন্তু ইনস্পেকটর অয়ন সাদৃশ্যপূর্ণ মৃত্যুগুলোর ফাইল সংগ্রহ করলেন। দিয়ে এলেন তার বন্ধু রোদের বাসায়। রোদ ফাইলগুলো চেক করছে। প্রত্যেক মৃত্যুই ঘটেছে একই উপায়ে। অর্থাৎ এসকল খুনের জন্য একজনই দায়ী। হয়তো সে কোনো সিরিয়াল কিলার। তার পাশে বসে থাকা সহকর্মী ফয়সাল জানালো "আমিও এই খুনগুলো নিয়ে ভাবছি, খুনগুলো হয়েছে ঠিক সন্ধ্যায়। খুনের আশেপাশের এলাকাজুড়ে লোকজন আকাশে কালো ছায়া দেখতে পেয়েছিল বলে জানায়।" হঠাৎ রোদের মনে ঝিলিক দিয়ে ওঠে পুরানো সেই খবরটা। অদ্ভুত প্রাণীটাও আকাশ কালো ছায়ার মতো আবির্ভূত হতো। কিন্তু খুনগুলো শুরুর পর থেকেই সেটি লাপাতা। কোনো খোঁজই নেই। খুনের খবরের আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে সে। ভ্রূ কুঁচকে ওঠে রোদের, খুনগুলোর সাথে অদ্ভুত প্রাণীটার কোনো যোগাযোগ নেই তো? রোজকারের মতো কাজ শেষে বাসায় ফিরছিল রাজেশ। সূর্যাস্ত হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। কমলা আলোর রেশটুকু মুছে যাওয়া মাত্রই রাজেশের সামনে নেমে এল সবুজ চোখের একটি প্রাণী। কাছাকাছি ল্যাম্পপোস্ট নেই যে প্রাণীটাকে ভালো করে দেখবে। রাজেশকে অবাক করে দিয়ে প্রাণীটা মানুষের মতো বলে উঠল "যারা আমার প্রশ্নের উত্তর জানে না তাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই। আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে তুমি বাঁচবে, না পারলে অন্যদের মতো মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হবে। বলো আমি তোমাদের এই জগৎ থেকে কিভাবে নিজের জগতে ফিরে যাবো?" রাজেশ উপস্থিত বুদ্ধি খাটালো "তোমার প্রশ্নের উত্তর কি তুমি নিজে জানো? যদি জেনে থাকো তাহলে শুধু শুধু অন্যদের জিজ্ঞেস করছো কেন? আর যদি না-ই জানো তাহলে আমার সঠিক কিনা বুঝবে কিভাবে?" রাজেশ দেখলো আসলেই প্রাণীটা তার কথায় বিভ্রান্ত হয়েছে। সে আর দেরি করলো না। আস্তে আস্তে পিছন দিয়ে পালিয়ে গেল। রাজেশ রোদের সামনে বসে আছে। রোদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে রাজেশ মানসিক ভারসাম্যহীন কিনা। কিন্তু এরকম কোনো লক্ষণই পাচ্ছে না। অবশেষে, রাজেশের কথাই তাকে বিশ্বাস করতে হল। রোদ বললো "তোমার কথায় মনে হচ্ছে প্রাণীটা ভিন্ন জগতের। কোনোভাবে আমাদের জগতে এসে পড়েছে। এখন ফিরে যেতে ব্যাকুল। কিন্তু যাওয়ার উপায় না জানায় সে একের পর এক মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে। এখন আমাদের করণীয় হচ্ছে প্রাণীটার ইতিহাস বের করা। কোথা থেকে এসেছে জানতে পারলেই ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা যাবে।" ফয়সাল চুপ করে এদের কথা শুনছিল। হঠাৎ সে বলে উঠলো "মনে হচ্ছে জানালা দিয়ে কেউ আমাদের উপর লক্ষ্য রাখছে।" রোদের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল "তোমার ধারণা একদম ঠিক ফয়সাল।" এবার জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে গলার স্বর উঁচু করে রোদ বলল "লুকোচুরি করে লাভ নেই, আমরা আপনার অস্তিত্ব জেনে গিয়েছি। প্রকাশ্যে আসুন।" ঘরের তিনজনকেই বিস্ময়ে অভিভূত করে আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা এক ব্যক্তি জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। রোদের ঘরে মিটিং এর জন্য আগে থেকেই চেয়ার রাখা থাকে। তার একটায় অনাহূত ব্যক্তি বসলেন। সবাই ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে আছে। পরিবেশ হালকা করার জন্য ফয়সাল একটু হেসে আগন্তুককে জিজ্ঞেস করলো "আপনি কে? আমাদের কথাবার্তা শুনে আপনার লাভ কি? আগন্তুক তার বিচিত্র গলার স্বরে বলে উঠল "আমি এজগতের নই।" "আপনি এজগতের না হলে কোন জগতের?" প্রশ্ন করল রোদ। উত্তরে আগন্তুক বলল "সে এক লম্বা কাহিনী। শুনতে চাও?" রোদ মাথা নাড়লো আর রাজেশ বললো "হ্যাঁ"। আগন্তুক তার কাহিনী বলতে শুরু করলো "আমরা চতুর্মাত্রিক জীব। লক্ষ্য কর, আমরা বলেছি, আমি না। আমাদের জন্ম হয় জোড়ায় জোড়ায়। কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন এর নাম শুনেছ নিশ্চয়ই। ত্রিমাত্রিক বিশ্বে এ প্রক্রিয়ায় শুধু কণা তৈরি হতে পারে। কিন্তু চতুর্মাত্রায় এ প্রক্রিয়া জীবের সৃষ্টি করতে পারে।" এপর্যন্ত বলার পর ফয়সাল হাত তুললে আগন্তুক থামল। "আচ্ছা কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন কী? এতে কণা কিভাবে তৈরি হয় আর আপনারাই বা কিভাবে তৈরি হন?" "বলছি শোন, কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন মতবাদ অনুযায়ী বিশ্ব তৈরি হয়েছে শূন্য থেকে। সমমানের ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ একে অপরকে নিস্ক্রিয় করে শূন্য তৈরি করে। এর বিপরীত প্রক্রিয়াও সম্ভব। অর্থাৎ শূন্য থেকে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক শক্তি উৎপন্ন হওয়া। এতে শক্তির নিত্যতা সূত্রও বজায় থাকে। কারণ সৃষ্ট শক্তিদ্বয় একত্রিত হলে পুনরায় শূন্য হয়ে যেতে পারে। এখন, ধনাত্মক শক্তি E=mc^2 সূত্র মেনে কণায় রূপান্তরিত হয় আর ঋণাত্মক শক্তি মহাকর্ষ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এটা গেল ত্রিমাত্রিক অবস্থা। চতুর্মাত্রায় ধনাত্মক ও ঋণাত্মক শক্তিদ্বয় দুটি ভিন্ন প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়। প্রাণীদ্বয় এমনভাবে তৈরি হয় যেন বিশেষ এক পরিস্থিতিতে তারা একত্রিত হলে শূন্যে পরিণত হতে পারে। তাদের শক্তি বিপরীত, গুণাগুণও বিপরীতধর্মী হয়ে থাকে। একটি সত্ত্বা ধ্বংসাত্মক হলে অপর সত্ত্বা গঠনমূলক হয়। একটি নিষ্ঠুর হলে অপরটি দয়ালু হয়। এত কথা আমি তোমাদের জানাচ্ছি কারণ তোমরা যে প্রাণীটাকে নিয়ে আলোচনা করছেন সেটি আমারই দ্বিতীয় সত্ত্বা। রাজেশ সাথে সাথে লাফিয়ে উঠল "মানে আপনিও সেরকম একটি প্রাণী? আমাদের খুন করবেন?" আগন্তুক উঠে দাড়ালেন "আরে, শান্ত হও। আমি ওই প্রাণীর বিপরীত ধর্মের। অর্থাৎ, আমি গঠনমূলক সত্ত্বা। আমি কারো ক্ষতি করি না, বলা যায় করতে পারি না। কাউকে খুন করা আমার বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থী।" ফয়সাল জিজ্ঞেস করল "আপনারা আমাদের ভাষা জানেন কিভাবে?" আগন্তুক শব্দ করে হেসে উঠল “আমরা চতুর্মাত্রিক জীব। ত্রিমাত্রিক সকল জীব ও জড়ের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারি। শুধু আপনাদের নয়, পশুপাখির ভাষাও আমরা বুঝতে পারি।" রাজেশ জানতে চাইল "আচ্ছা, আপনাদের যে দেখে সেই অজ্ঞান হয়ে যায় কেন?" এবার উত্তরটা দিলো রোদ "আমাদের মস্তিষ্ক চতুর্মাত্রিক কিছু দেখতে অভ্যস্ত নয়। তাই চতুর্মাত্রিক কিছু দেখামাত্রই এটি তা সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারায়।" ফয়সাল বলল "ওহহ, এবার বুঝেছি আপনার গায়ে চাদর কেন। চাদর না থাকলে তো আমরা এতক্ষণে অজ্ঞান হয়ে যেতাম।" আগন্তুক সমর্থন জানাল "হ্যাঁ, এজন্যই আমার এ চাদর দেওয়া।" রোদ জানতে চাইল "সবই তো বুঝলাম। কিন্তু কথা হল, আপনারা আমাদের জগতে এলেন কিভাবে? ফেরতই-বা যাবেন কিভাবে?" আগন্তুকের গলায় হতাশা ঝরে পড়ল "সেটা আমিও ঠিক জানি না। তবে খুব সম্ভবত আমার দোষেই আমরা ত্রিমাত্রিক জগতে আটকে গিয়েছি। আমি ত্রিমাত্রায়ন নিয়ে গবেষণা করছিলাম। গবেষণার একপর্যায়ে ওয়ার্মহোল তৈরি হয় আর আমরা তোমাদের জগতে এসে আটকে যাই। এব্যাপারে আমার দ্বিতীয় সত্ত্বা কিছুই জানে না। তাই সে আরো হিংস্র হয়ে উঠেছে। তার ধারণা মানুষেরাই তাকে এ জগতে এনে আটকে রেখেছে। একারণে প্রতিশোধ হিসেবে সে একের পর এক মানুষ মেরেই চলছে।" রোদ জিজ্ঞেস করলো "তার মানে আপনারা আপনাদের জগতে ফিরে যেতে অক্ষম! তাহলে এ খুনাখুনি থামবে কিভাবে?" আগন্তুক উত্তর দিল " উপায় একটাই আছে। আমরা পুনরায় শূন্যে পরিণত হব। আমরা এজগতের নই। এজগতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকারও আমাদের নেই।" কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে আগন্তুক নিজেই আবার বলতে শুরু করল "আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। কিন্তু আমি সেই বিশেষ অবস্থা আমি একা তৈরি করতে পারি না। তোমাদের সাহায্য প্রয়োজন। তোমরা কি রাজি?" রোদ সবার পক্ষ নিয়ে বলল "পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য আমরা যেকোন পদক্ষেপ নিতে রাজি" আগন্তুক বলল "বেশ, এবার আমার নির্দেশনা অনুসরণ করো।" "রাডারে আপনার দ্বিতীয় সত্ত্বাকে লক করে ফেলা হয়েছে" জানাল ফয়সাল। "ওর উপর কসমিক রেডিয়েশন প্রয়োগ করো।" নির্দেশ দিল আগন্তুক। "ও কসমিক রেডিয়েশনে তেমন আহত হবে না, তবে উৎস খুঁজে বের করতে আসবে অবশ্যই। তখন আমি ওকে নিয়ে শূন্যে মিলিয়ে যাব। তোমরা পরিস্থিতি তৈরিতে সমর্থ হয়েছো। ধন্যবাদ।" এরপর আগন্তুক রোদের হাতে একটা কাগজ দিয়ে বলল "আমার মৃত্যুর পর এই কাগজটা পড়বে।" জানালায় সবুজ চোখ দেখা দিল। সাথে সাথে আগন্তুক ছুটে গেল তার দিকে। দুজনেই মিলিয়ে গেল শূন্যে। রোদের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল। কাগজটা পড়তে শুরু করল সে। "আমার ভুলের জন্য কিছু মানুষের প্রাণ গেল। আমি এর জন্য লজ্জিত। তাই প্রায়শ্চিত্ত করেছি জীবন দিয়ে। যদি ভবিষ্যতে প্রয়োজন হয়, তোমরা এভাবেই পৃথিবীকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসো।"

ঘৃণিত মানব

-এখানে হয়তো জীবন আছে। -নাও থাকতে পারে। উষর এবং বন্ধ্যা গ্রহ। -কিন্তু রেডিও একটিভ সিগন্যাল তো আমরা এখান থেকেই পেয়েছি। -ওটা হয়তো প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট কোনো রেডিও সিগন্যাল। -তাহলে আরো কিছু রুটিনমাফিক টেস্ট করে ফেরত রওনা দিই। কি বলো? -আচ্ছা। মিলার এবং স্টার্ক আরো কিছু টেস্ট শুরু করলো। তাদের অলক্ষ্যে তাদের উপর নজর রাখছিলো দুটি মহাজাগতিক জীব। -তোমার কি মনে হয় না এই জীবগুলোকে আমাদের পরিচয় দেয়া উচিত? -থাক, আমি আগে দেখতে চাই ওরা আমাদের অস্তিত্ব শনাক্ত করতে কতোদিন সময় নেয়। এটা ওদের বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা। -কিন্তু আমরা তো চতুর্মাত্রিক। আমাদেরকে তারা কখনোই শনাক্ত করতে পারবে না যতদিন না আমরা চাইবো। -একদিন তো ওরা আরো উন্নত হবে চতুর্মাত্রা জয় করবে, তখন? -ততদিনে আমরাও পঞ্চমমাত্রা জয় করে নিজেদের লুকিয়ে রাখবো। -তাহলে কি মানুষেরা কখনো আমাদের অস্তিত্ব জানবে না? -জানানোর প্রয়োজন নেই। যারা নিজেদের গ্রহ পৃথিবীকে এতো দূষিত করে তাদের থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়। অতিক্ষুদ্র জীবানুর জন্য মানুষকে কতো ঝামেলা পোহাতে হয়। ওরা আমাদের অস্তিত্ব জানলে আমাদের উপর আক্রমণ করবে না তার কি নিশ্চয়তা। আমরা নির্বিবাদী জীব, কোনো সংঘর্ষে লিপ্ত হতে চাই না। ওরা থাকুক ওদের দূষিত পৃথিবীতে।

অতিমানব

সকালটা খুব সুন্দর লাগছে আমার। কি মিষ্টি রোদ! আকাশে তুলোর মতো কিছু মেঘ এই সৌন্দর্য যেন বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু উপায় নেই। আমার জীবন যে ছকে বাধা। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ নীরস তত্ত্ব বিশ্লেষণ শুরু করতে হয়। প্রথমদিকে কাজটা আমার ভালো লাগতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এতে একঘেয়েমি ধরে গিয়েছে। তাও আমি এটাই করে যাই। পিএইচডি করতে হলে পরিশ্রম তো লাগবেই। আলসেমির রাশ কাটিয়ে উঠে ফ্রেশ হলাম। কাগজপত্র নিয়ে টেবিলে বসতেই একটা কাগজে চোখ আটকে গেলো। ওটা আলাদাভাবে হাতে নিয়ে পড়তে লাগলাম। এই কাগজ আমার গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কথা নয়, তাহলে এটা এখানে কিভাবে এলো! কাগজে বৈজ্ঞানিক ভাষায় কৃত্রিম বিবর্তনের কিছু অনুকল্প তুলে ধরা হয়েছে। অথচ আমার গবেষণার বিষয় হলো জিনেটিক ইন্জিনিয়ারিং। অবশ্য এ দুয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম সম্পর্কও রয়েছে। কৃত্রিম বিবর্তনে জিনেটিক ইন্জিনিয়ারিং ব্যবহৃত হয়। তাই হয়তো ভুল করে আমাকে এসব কাগজপত্র দেয়া হয়েছে। লেখার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে আকৃষ্ট করলো। আগ্রহের সাথে পুরোটা পড়ে ফেললাম। এটা আসলে পুরাতন সময়ের এক বৈজ্ঞানিকের গবেষণা। তখনকার সময়ে তার অনুকল্প প্রমান করা সম্ভব হয়নি, নয়তো তার অনুকল্পটি তত্ত্বে রুপান্তর হতে পারতো। এখনও তার অনুকল্পটি বাস্তবায়ন অনেকটাই জটিল, তবে আমি আমার গবেষণার সাথে এটিকে সমন্বিত করলে আমি সফল হতেও পারি। যদি আমার সাফল্য আসে, গবেষণাপত্র মতে সৃষ্টি হবেঃ অতিমানব! আল্ট্রাহিউম্যান! সাধারণ মানুষের তুলনায় হাজারগুন শক্তিশালী এবং বুদ্ধিমান। প্রচুর ক্ষমতা থাকবে যেমন উড়তে পারা, এক্স-রে ভিশন, লেসার নিক্ষেপ ইত্যাদি। কাগজটা আমার হাতে এসে ভালোই হয়েছে। অন্য কোনো জিনেটিক ইন্জিনিয়ার পেলে এবং তার গবেষণা আমার গবেষণার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হলে সে অতিমানব হয়ে যেতে পারতো। এবার আমি হবো অতিমানব, সমস্ত পৃথিবী শাসন করবো! এখন শুধু পরিশ্রমের পালা এবং সাফল্যের প্রতীক্ষা। কাগজটা ছোট হলেও এর মধ্যে রয়েছে মাসখানেকের কাজ। তার উপর আমি তো আলসে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এবং আমার গবেষণা যুগপৎ প্রয়োগের ফলে ২০ দিনের মধ্যেই আমি চূড়ান্ত ফলাফল পেলাম। আবিষ্কারটাকে বৈজ্ঞানিক প্যাঁচ ছাড়া সাদামাটাভাবে বলা যায়, জিনেটিক ইন্জিনিয়ারিং দ্বারা মডিফাইড ডিএনএ(অতিমানবিক ডিএনএ) প্রস্তুত এবং শরীররকে সেই ডিএনএ দ্বারা আপডেট করা। অর্থাৎ স্বাভাবিক ডিএনএ-কে অতিমানবিক ডিএনএ দ্বারা প্রতিস্থাপন। আবিষ্কার সমাপ্ত হওয়ার পরপর আমি নিজের উপরেই তা প্রয়োগ করলাম। প্রথমদিকে মাথাটা ঘুরিয়ে উঠলো। এরপর শুরু হলো খিচুনি। এটা কি আবিষ্কারের সাইড-ইফেক্ট নাকি গবেষণার ব্যর্থতা? আমি কি মারা যাচ্ছি? কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে আরো সতেজ মনে হতে লাগলো। সোজা হয়ে দাড়াতে গিয়ে দেখলাম উচ্চতা প্রায় ৮ফুট উচ্চতা হয়ে গিয়েছে। শরীরের সমস্ত পেশি রেসলারদের মতো মনে হচ্ছে। জানালার গ্রিল ধরে টান দিতেই গ্রিলটা বেঁকে গেলো। নিজেকে অ্যাভেন্জারস এর হাল্ক মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি কি উড়তে পারি? লিফটে করে ছাদে চলে গেলাম। দৌড়ে এসে রেলিং থেকে দিলাম এক লাফ। কিন্তু এ কী, আমি তো উড়ছি না৷ মাটির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। মাটিতে আছরে পড়ার ঠিক আগের মূহুর্তেই হাত দুটো ছড়িয়ে দিলাম। শেষরক্ষা হলো; উঠে আসলাম আকাশে। হাত ওঠানামা করে আকাশে উড়তে উড়তে দিক পরিবর্তন করা যায়। উড়ার গতিবেগও পরিবর্তন করে জেট প্লেনের চেয়ে দ্রুত উড়লাম। একটা পাখি এগিয়ে আসছিলো আমার দিকে। পাখিটার দিকে ফোকাস করে তাকালাম। চোখ থেকে লেসার বেড়িয়ে এসে পাখিটাকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিলো। নিজের ক্ষমতার উপর কনফিডেন্সে অনুভব করছি। উড়াল দিয়ে চলে গেলাম ফ্রান্সে। আইফেল টাওয়ারের গোড়ায় ফোকাস করতেই পুরো টাওয়ার সশব্দে ভেঙে পড়লো। চিৎকার-চেঁচামেচিতে এলাকা ভরে যেতেই আমি আবার বাসায় ফিরে আসলাম। টিভি অন করতেই দেখি টিভিতে আমার ছবি! আইফেল টাওয়ার ভাঙার সময় কোন অনুসন্ধিৎসু আমাকে আকাশে আবিষ্কার করে ভিডিও ধারন করে রেখেছে। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে গিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আমি তো এটাই চেয়েছিলাম। বিশ্বের যেকোনো মানুষ এক ডাকে চিনবে এবং ভয় করবে। আমি বিশ্বকে শাসন করবো, কেউ ঠেকাতে পারবে না। বাসা পার্মানেন্টলি ছেড়ে দিলাম। অতিমানবের খাদ্য, ঘুম কোনোটাই প্রয়োজন নেই। ভর শক্তি রুপান্তর পদ্ধতিতে অতিমানব শক্তি পায়। মস্তিষ্ক এতো উন্নত যে ঘুমিয়ে বিশ্রাম নিতে হয় না। এখন আমার কাজ হলো মানবজাতিকে আমার ক্ষমতার পূর্ণ ধারণা দেয়া যাতে সবাই আমার দাসত্ব স্বীকার করে নেয়। ক্ষমতা প্রদর্শন খুবই সহজ, শুধু বিখ্যাত এবং সুরক্ষিত স্থাপনাগুলো ভেঙে দেওয়া। যারা আমার বিরোধীতা করবে প্রকাশ্যে তাদের হত্যা করতে হবে। জনমনে একবার ভয়ের জন্ম দিতে পারলে আর কোনো চিন্তা লাগবে না। এবার বেরিয়ে পড়লাম তাজমহলের উদ্দেশ্য। ভারতে গর্ব তাজমহল ধ্বংস করতে পারলেই ভারতের বিশ্বের এক-সপ্তমাংশ জনগন আমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। যেই ভাবা, সেই কাজ। এবার আর লেসার নয় হাত দিয়ে সনিক ওয়েভ তৈরি করে পুরো তাজমহল গুড়ো গুড়ো করে দিলাম। কাছাকাছি মানুষেরা অবশ্য বিনা অপরাধে মৃত্যুবরন করেছে নয়তো বধির হয়ে গিয়েছে। তাতে আমার কিছু আসে যায় না, সাধারণ মানুষ আমার কাছে কীটসম। আইফেল টাওয়ার ধ্বংসের পর তাজমহল ভাঙায় সমস্ত বিশ্বে হৈচৈ পড়ে গিয়েছে। আমার গবেষণা সহকর্মীরা আবার ভিডিও দেখে আমায় শনাক্ত করে সারা বিশ্বের মিডিয়ার সামনে আমার পরিচয় প্রকাশ করে দিয়েছে। একজন গবেষক কিভাবে এতো ক্ষমতার অধিকারী হলো তা নিয়ে অনুসন্ধান চলছে। একদল গোয়েন্দা আমার বাসায়ও গিয়েছিলো। কিছুই পায়নি, আমি আসার আগে আমার গবেষণার সমস্ত কাগজ পুড়িয়ে এসেছি যেন কখনো আমার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হতে না পারে। আন্তর্জাতিক নেতারা নাকি আমার বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছে! আরে, মুরগি, তার সংখ্যা যতই বেশি হোক না কেন তারা কি কখনো বাঘের বিরুদ্ধে জিততে পারে? মানবজাতির আজব কর্মকাণ্ড আমার হাসির খোরাক জোগায়। এতো কষ্ট না করে আমার বশ্যতা স্বীকার করলেই তো আমি আর তাদের ক্ষতি করবো না। কিন্তু মানুষ তো আর সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। অগত্যা, আমার আর কি করার! যুদ্ধ করতেই হবে। অবশ্য কোনো ক্ষেপনাস্ত্র দিয়ে কাজ হবে না, আমি যেকোনো ক্ষেপণাস্ত্রের চেয়ে দ্রুত ভ্রমন করতে পারি। তবুও সাবধানের মার নেই। সবসময় একটু সতর্ক থাকা ভালো। তাছাড়া এখন আমি আছি মনুষ্য লোকালয় থেকে বহুদূরে এক জঙ্গলে। এখানে আমার অবস্থান কিছুটা নিরাপদ, সচরাচর কেউ এখানে আসে না। নীল আকাশের ছায়াতলে মৃদুমন্দ বাতাস উপভোগ করতে করতে আমি আমার পরবর্তী লক্ষ্য নির্ধারণ করে ফেললাম। এবার আমার গন্তব্য পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের একটি যা হল চীনের মহাপ্রাচীর। কয়েক মূহুর্ত উড়ে চলে এলাম চীনে। জনসমাগম ঠিকই রয়েছে, কারণ আমি কখনো সরাসরি মানুষের উপর আক্রমণ করিনি। কিন্তু পরপর দুবার ধ্বংসলীলা দেখায় বিশ্ববাসী সচেতন ছিল। আমি চীনের মহাপ্রাচীরের কাছাকাছি আসতে না আসতেই অনেকেই আমায় দেখে ফেলে। আমি ইংরেজিতে সবাইকে নির্দেশ দেই "আমি মানুষের ক্ষতি চাই না, জীবন বাঁচাতে চাইলে এস্থান দ্রুত পরিত্যাগ করো"। বেশিরভাগ পর্যটকই আমার কথা বুঝতে পেরে পালিয়ে যায়। স্থাপনা যত মূল্যবানই হোক জীবন তো সবার আগে! এবার আমি পুনরায় সনিক ওয়েভ সৃষ্টি করে সম্পূর্ণ মহাপ্রাচীর ধুলোয় মিশিয়ে দিলাম। চীনের অধিবাসীরা এবার থেকে আমায় ভয় করে চলবে। চীনের মহাপ্রাচীর ধ্বংসের পরই আমার মনে ভেসে উঠলো পিরামিডের ছবি!পিরামিড, লক্ষ মানুষের পরিশ্রমে গড়া স্থাপনা, গুড়িয়ে দিলে বিশ্বের টনক নড়বে। আমার ভয়ে যেনো আন্তর্জাতিকভাবে বড় কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় সেটাই দেখতে চাই আমি। সময় নষ্ট না করে মিশরে গিয়ে বড় পিরামিডগুলো এক নিমিষে ধুলিস্যাৎ করে দিলাম। এবার আমি ফিরে যেতে পারি আগের জঙ্গলে। পৃথিবীতে সমস্ত খবর ছড়িয়ে পড়তে কিছু সময় দেয়া উচিত। দুদিনের মধ্যে মানবজাতির শিল্পের চূড়ান্ত চারটি নিদর্শন লুপ্ত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ঐক্যবদ্ধতা সৃষ্টি হলো। চীন, রাশিয়া, আমেরিকা, ফ্রান্স, কোরিয়া ইত্যাদি প্রমিত শক্তিধর দেশসমূহ চুক্তি করে একত্রিত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন, হানাহানিতে লিপ্ত মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছি, এটা ভেবেই মনে প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ শুনতে পেলাম আকাশে বিমানের শব্দ। এ জঙ্গলের উপর দিয়ে তো বিমানের চলাচলের কথা না! তাহলে এরা কি করছে? ভালো করে তাকাতেই বুঝতে পারলাম এ সাধারন যাত্রীবাহী বিমান নয়, এগুলো যুদ্ধবিমান। আমার অবস্থান আর গোপন নেই তাহলে। কাছাকাছি আসতেই গুলিবর্ষন শুরু করলো বিমানগুলো। আমি লেসার ছুড়লাম আকাশে, একটা বিমান ভূপতিত হলো। এরপর আমি উড়ে আকাশে চলে এলাম সামনাসামনি লড়াই করতে। বিমানের গুলি আমার গায়ে লাগলে ছোট ধাক্কা অনুভূত হচ্ছে, এছাড়া কোনো সমস্যা নেই। প্রচুর গুলির পরেও যখন আমায় মারতে পারলো না তখন ওরা রকেট মিসাইল মারতে শুরু করলো। আমি একটা মিসাইল ধরে তার গতিপথ পাল্টে বিমানের দিকে করে দিলাম। নিজের মিসাইলে নিজেই ধ্বংস হয়ে গেলো কয়েকটি বিমান। শেষ বিমানটিকে সনিক ওয়েভ দিয়ে গুড়োগুড়ো করে দেয়ার পর আমার আত্মবিশ্বাস দ্বিগুন হয়ে উঠলো। ধ্বংস হয়ে যাওয়া বিমানে দেখলাম আমেরিকার পতাকা খোদাই করা । অর্থাৎ আমেরিকা আমার বিরুদ্ধাচরণ করছে। ওদের আমার ক্ষমতার পরিচয় দিতে হবে। উড়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে এসে ইউরেনিয়াম প্ল্যান্ট খুঁজে বের করলাম। কিছু লেসার কেন্দ্রীভূত করতেই আগুন জ্বলে উঠল। আমি দ্রুত স্থান পরিত্যাগ করতে করতেই বিরাট পারমানবিক বিস্ফোরণ ঘটে গিয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ বিনা অপরাধে মারা গেলো শুধু আমেরিকা সরকারের হঠকারিতার জন্য। ভেবেছিলাম আমেরিকা সরকার আমার আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে আমার আনুগত্য স্বীকার করবে, উপরন্তু সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। টিভিতে দেখাচ্ছে কিভাবে আমার উপর আক্রমনের প্রস্তুতির প্রক্রিয়া। অসংখ্য বিমান, মিসাইল এমনকি পারমানবিক বোমা পর্যন্ত বরাদ্দ করা হয়েছে আমায় নির্মূলের জন্য। দেখা যাক মানুষের দৌড় কদ্দূর! কাল চার-পাঁচটি দেশের শতাধিক বিমান ও সহস্র সেনা আমাকে আক্রমন করবে। আমার অবস্থান সর্বদা স্যাটেলাইট দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে যেনো আমি লুকাতে না পারি। অবশ্য লুকানোর কোনো প্রশ্নই নেই, ওরা এখনো আমার প্রকৃত শক্তির আন্দাজ পায়নি বলে ভাবছে আমি লুকাবো। কোনোভাবে আজকের দিনটা কাটিয়ে দেই, কাল থেকে শুরু হবে আমার রাজত্ব। ভোর হয়ে গিয়েছে। আমি অপেক্ষা করছি মানুষের আক্রমনের জন্য। দেখতে দেখতে সূর্য একটু উজ্জ্বল হতেই আকাশের কোনে উঁকি দিতে লাগলো একের পর এক যুদ্ধবিমান। সংখ্যায় এবার এতে বেশি যে পঙ্গপাল মনে হচ্ছে। সবাই মিলে এবার লেজার আক্রমণ করছে। সর্বনাশ!আমার তো লেজারের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা নেই! একটাই উপায় আছে এখন। কোনোভানে ওদের লেসারকে রিফ্লেক্ট করতে হবে। উড়ে গিয়ে একটা বিমানকে আঘাত করলাম, জানালার কাচ ভেঙে আমার হাতে চলে এলো। বেশ বড় কাঁচের টুকরো, এ দিয়ে ভালোভাবেই লেজার প্রতিফলিত করা যাবে। এবার আমি অতিমানবিক গতিতে প্রতিটি লেজার ফিরিয়ে দিতে লাগলাম। অনেক লেজারই প্রতিফলিত হয়ে আরেক বিমানকে ধ্বংস করে দিলো। প্রচুর বিমান ধ্বংস হওয়ায় ওরা একসময় বুঝলো লেজার দিয়ে এভাবে আমায় কাবু করা যাবে না। ওরা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত মিসাইল ছুড়লো। অন্য মিসাইলের দিক পরিবর্তন করা গেলেও এগুলোর দিক অপরিবর্তনীয়। লক্ষ্যবস্তুতে লক হয়ে তার উপর বিস্ফোরিত হয়। এবার শুরু করতে হবে আকাশবাজী! মিসাইলগুলো আমার দিকে আসতেই ক্ষিপ্র গতিতে আকাশে উড়ে এলাম, আমার পিছন পিছন মিসাইলগুলিও এলো। আমি একটা বিমানের উপরে বসে পড়তেই মিসাইলগুলি আবার আমার দিকে আসতে লাগলো। আমায় আঘাতের ঠিক আগের মুহুর্তে আমি সরে গেলাম আর মিসাইলগুলি বিস্ফোরিত হলো বিমানে। এভাবে একের পর এক মিসাইল দিয়ে একের পর এক বিমান ধ্বংসলীলা চলতে লাগলো। বিমানের সংখ্যা যখন একেবারেই কমে এসেছে হঠাৎ দেখলাম বিশাল আকারের এক বোমা আমার ঠিক পাশেই পড়তে যাচ্ছে। আমি উপরে উড়ে আসবো, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে। বিকট শব্দ করে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটলো। আমি বিস্ফোরণের ধাক্কায় প্রায় কয়েক কিলোমিটার দূরে ছিটকে গিয়েছি। শরীরের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি, হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। আবার উড়ে বিস্ফোরণস্থলের কাছাকাছি গিয়ে দেখি বিমান কয়েকটি রয়ে গিয়েছে। আমাকে দেখে তারা সবাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। পালানোর চেষ্টা করা মাত্রই সনিক ওয়েব দিয়ে সবকটিকে গুড়িয়ে দিলাম। যাক, অবশেষে মানবজাতির সাথে চূড়ান্ত সংগ্রামে বিজয়ী হয়েছি। আজ দুপুরেই লোকালয়ে গিয়ে নিজের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে আসবো। কিন্তু একটু পর থেকেই কিছুটা অসুস্থতা বোধ শুরু হলো। এমনতো হওয়ার কথা নয়! আমি তো মানুষ নই, মানুষের কোনো রোগ আমার হতে পারবে না। তাহলে এমন অসুস্থ বোধ হওয়ার কারণ কী! শীঘ্রই পরীক্ষা করে দেখতে হবে। একটা ফার্মেসীর কাছাকাছি যেতেই ফার্মেসীর ভিতরের লোকজনসহ আশেপাশের সবাই পালিয়ে গেলো। বাহ, তার মানে এখন সবাইই আমাকে চেনে। কিন্তু এখন এসব ভাবলে চলবে না, পরীক্ষার সরঞ্জাম নিতে হবে। প্রয়োজনীয় কেমিক্যালস এবং যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যাগে ভরে অন্য এক দুর্গম এলাকায় চলে আসলাম। প্রথমে ব্লাড টেস্ট করে দেখি। ফলাফল আসলো আমার রক্তে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক ভাইরাস রয়েছে। ভাইরাসটির উপর গবেষণা করে বুঝলাম, এ ভাইরাস সাধারণ ভাইরাস নয়। এ হলো অতিভাইরাস। পরিবেশেই এই ভাইরাস রয়েছে, তবে সাধারণ জীবকে কখনো এ ভাইরাস আক্রমন করে না। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য পরিবেশে অনেক আগে থেকেই অতিভাইরাস ছিল। এটি আক্রমণ করতে পারে অতিমানবকে। অতিভাইরাসে মানুষের কোনো ক্ষতি না হলেও অতিমানবকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। তবে কি এই আমার শেষ পরিণতি?মানবজাতিকে জয় করে তুচ্ছ ভাইরাসের কাছে হেরে যাবো? আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে ভাইরাসের প্রভাবে, আর বেশিক্ষণ হয়তো সময়ও নেই আমার হাতে। যদি আমি সাধারণ একটা মানুষ হতাম তাহলে আজ এভাবে মারা যেতে হতো না। আমার সমস্ত অতিমানবিক ক্ষমতা এখন মূল্যহীন। এই ক্ষমতা দিয়ে না আমি মানুষের কোনো উপকার করতে পেরেছি আর না তো এখন নিজেকে বাঁচাতে পারবো। মৃত্যুর আগে আমার শেষ আক্ষেপঃ "যদি মানুষ হতে পারতাম!"

দুটি ভুল

"তুই কিন্তু কাজটা ঠিক করছিস না, রোদ। অবন্তীকে ভুলে যা। জানিস না আমি অবন্তীকে ভালোবাসি?" -বললো পারভেজ। মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে আমার। আমার ৩ বছরের ভালোবাসার মেয়েটিকে এভাবে নিজের বলে দাবি করছে। আমিও উত্তর দিলাম-"অবন্তী তোকে ভালোবাসে, হুহ?" ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকালো পারভেজ-" দাড়া তোকে প্রমান দেখাই" "হ্যা দেখা, আমিও দেখতে চাই।" পকেট থেকে ফোন বের করে পারভেজ কল দিলো অবন্তীকে। অবন্তীঃ হাই পারু, কি করছো? পারভেজঃ তোমার কথা মনে পড়ছে। একবার আই লাভ ইউ বলোনা! অবন্তীঃ আই লাভ ইউ! হঠাৎ আমার মনে হলো পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। মাথা ঘুরছে, দাড়াতে পারছি না। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করলাম। বাঁকা হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকা পারভেজকে অগ্রাহ্য করে চলে আসলাম বাসায়। মাথায় তখনো প্রচুর যন্ত্রণা। কোনো প্রিয়জন যখন অন্যের হয়ে যায় তখন পৃথিবীটাকেই অর্থহীন মনে হয়। কেউ এ কষ্টে জমে পাথর হয় আবার কেউ এ কষ্টে জ্বলে ওঠে। আমি পাথর হওয়ার মতো নই, প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে উঠলাম। পারভেজ এবং অবন্তী যদি এক হতে চায় তাহলে হবে কিন্তু অবশ্যই মৃত্যুর পর; আমার সামনে নয়। ওদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনাও করে ফেলেছি। মাঝরাতে বেরিয়ে পড়লাম ছোটবেলার বন্ধু পারভেজের বাসার উদ্দেশ্যে। পাইপ বেয়ে ছাদে উঠে চলে আসলাম পারভেজের রুমে। ছোট একটা ছুরি বুকের বামপাশে গেথে দিয়ে মুখে কাপড় গুজে বললামঃ তোর বন্ধুত্বের পুরস্কার। কিছু বলতে চাইছিলো, সে সুযোগ দিলাম না। এখন আমার লক্ষ্য অবন্তী। একই পদ্ধতিতে অবন্তীকেও বিদায় দিলাম। ওর জন্য বললামঃ "তোমার ভালোবাসার প্রতিদান।" কিছু বলতে না চাইলেও অবন্তী হাত দিয়ে টেবিলে ইশারা করে স্থির হয়ে গেলো। টেবিলে দেখি একটা চিঠি। তাতে লেখাঃ "শুভ জন্মদিন রোদ। তোমার জন্মদিনে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতেই আমার ও পারভেজের এই প্ল্যান ছিলো। আমরা তোমাকে খুব ভালোবাসি। গত দুদিন একটু প্র্যাঙ্ক করেছি যেনো জন্মদিনের উইশ তোমার জন্য সবচেয়ে স্মরণীয় হয়। আমাকে তোমার জীবনসঙ্গী করবে? আর পারভেজকে বেস্ট ফ্রেন্ড? আজীবন তোমার পাশে থাকতে চাই আমরা।" ঝাপসা হয়ে আসছে চিঠিটা, একটু পর নোনা জলে ভিজে গেলো। যারা আমায় সবচেয়ে ভালোবাসতো তাদেরই আমি সরিয়ে দিলাম? আমার আর বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই। অবন্তী! পারভেজ! আমি আসছি তোমাদের কাছে!

আইসক্রিমাস্ত্র

সকালবেলার মিষ্টি আলোয় রোদ নিউজপেপার পড়ছিলো। আজকাল বিভিন্ন চটকদার খবরে নিউজপেপার ভরে থাকে। সত্যিকারের খবর পাওয়া যায়ই কম। হঠাৎ একটা খবরে রোদের চোখ আটকে গেলো। শিরোনামঃ নীলকান্তপুরে রহস্যজনক খুন! ডিটেইলসে লেখার সারমর্ম মোটামুটি এই - একটি পুরাতন পোড়োবাড়িতে একটা লোকের লাশ পাওয়া গিয়েছে। তার পেটে গর্ত এবং প্রচুর পিপড়াও পাওয়া গিয়েছে। রহস্য দেখেই চঞ্চল হয়ে উঠলো রোদের মন। ছোটবেলা থেকেই রহস্যপিপাসু রোদ। এজন্যই বড় হয়ে বেছে নিয়েছে গোয়েন্দা পেশা। ইতোমধ্যেই জটিল কিছু রহস্যের সমাধান করে কয়েকদিনের রেস্টে ছিলো। কিন্তু রহস্যের টান তো রক্তে মিশে গেছে, তাই এ ডাকটা আর অগ্রাহ্য করতে পারলো না সে। নীলকান্তপুর খুব একটা দূরে নয়, দু ঘন্টার জার্নি করেই রোদ পৌঁছে যায় ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী পুলিশ স্টেশনে। সেখানে জিজ্ঞেসাবাদ করে জানতে পারে, গত পরশু একটা লোক পোড়োবাড়িতে সিগারেট খেতে গিয়ে লাশ দেখে এবং পুলিশকে খরব দেয়। পুলিশ রহস্যজনক লাশটি উদ্ধার করে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে। বিজ্ঞপ্তির পর গতকাল নিহতের ভাই এসে লাশ শনাক্ত করে গিয়েছে। নিহতের নাম সাকিব। তার বাসা পুলিশ স্টেশন থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে। আপাতত লাশ পোস্টমর্টেম করা হচ্ছে। ইনচার্জ পুলিশ অফিসারকে নিজের পরিচয় দেয়ার পর রোদকে যথেষ্ট খাতির যত্ন করলেন অফিসার এবং তদন্তের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। রোদ সম্মতি জানিয়ে নিহতের বাড়ি চলে গেলো জিজ্ঞেসাবাদ করতে। ফিরে আসতে আসতে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চলে আসবে। বাসায় পৌছে রোদ দেখলো মোটামুটি বিরাট আলিশান বাড়ি। সম্পত্তি অনেক আছে বটে! সম্পত্তির জেরেই খুন হলো নাতো, প্রশ্নটা ঝিলিক দিয়ে গেলো রোদের মাথায়। দ্রুত চিন্তাটা ঝেড়ে ফেললো সে, এভাবে সব না জেনে হঠাৎ ডিসিশন নেয়া যায় না। বাড়ির দরজায় কলিংবেল বাজালো রোদ। একজন বিমর্ষ ২০-২২ বছরের যুবক দরজা খুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। রোদ আইডি কার্ডটা দেখিয়ে নিজের পরিচয় দেয়ার পর সে রোদকে ভিতরে নিয়ে গেল। সেখানে আরেক নিরাসক্ত মহিলার দেখা। সম্ভবত আগে অনেকক্ষণ ধরে কেঁদে এখন শক্ত হয়ে গিয়েছেন। পরিচিত হয়ে রোদ জানতে পারলো যুবকটি সাকিবের ছোট ভাই তাহমিদ এবং মহিলাটি তার মা ফাহমিদা। রোদঃ সাকিবকে আপনারা শেষ কখন দেখেছিলেন? ফাহমিদাঃ গত পরশু বিকালে। রোদঃ ওর লাশ পাওয়ার খবর কখন পেলেন? ফাহমিদা নিশ্চুপ। তাহমিদঃ ভাইয়ার লাশ গতকাল আমি শনাক্ত করে আসি। অবশ্য পুলিশ গত পরশু রাতেই ওর লাশ উদ্ধার করেছিলো কিন্তু আমাদের কাছে খবর পৌছাতে একটু দেরি হয়েছে। রোদঃ ফাহমিদা ম্যাম, আপনার এই বিশাল সম্পত্তির বর্তমান একমাত্র উত্তরাধিকারি তাহমিদ না? বিমর্ষতার মধ্যে ফুঁসে উঠল তাহমিদ, "কি বলতে চান আপনি? আমি আমার ভাইকে সম্পত্তির লোভে খুন করেছি?ছোটবেলার থেকে আমার নিবিড় সম্পর্ক৷ গত পরশু আমি আমার রুমে দরজা বন্ধ করে ছিলাম, মা-কে জ্ঞিজেস করতে পারেন। আর এরকম ক্রিমিনাল কাজ করার কোনো পূর্ব রেকর্ডও আমার নেই, কিসের ভিত্তিতে সন্দেহ করবেন?" রোদ আর কথা বাড়ালো না, রুটিনমাফিক কিছু প্রশ্ন করে সে উঠে পড়লো। এবার তার গন্তব্য খুনের স্পট। খুনের স্পটটা কাছেই, হেটে যাওয়া যায়। বাড়িটা আগে জমিদারদের ছিল। উত্তরাধিকারি না থাকায় এবং পরিচর্যার অভাবে বাড়িটা ভুতুড়ে হয়ে উঠেছে। খুনের স্পটে গিয়ে রোদ বেশ কিছু ময়লা জিনিসপত্র ছড়ানো ছিটানো পেলো। এরমধ্যে একটা খোসা দেখে রোদের স্মৃতিতে কিছু একটা ভেসে ওঠে। অমনি সেটা পকেটে পুরে নেয় রোদ। এখন শুধু পোস্টমর্টেম রিপোর্টের অপেক্ষা। হিসাব অনেকটাই মিলাতে পেরেছে রোদ। চলে এলো পুলিশ স্টেশনে। রিপোর্ট অনুযায়ী সাকিবের পেটে ধারালো কিছু দ্বারা গর্ত করা হয়েছিলো। রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। আর তার পেটের ক্ষতে বেশকিছু চিনি ও শুকিয়ে যাওয়া দুধ পাওয়া গিয়েছে। মৃত্যুর সময় গত পরশু বিকাল। রোদ ইনসপেক্টরকে বললো, "মিস্ট্রি সলভ। চলুন, অপরাধীকে আপনাদের হাতে তুলে দেই।" ইন্সপেক্টর তো অবাক! যেখানে অফিশিয়ালি তদন্ত পর্যন্ত শুরু হলো না, তার আগেই এতো দ্রুত রহস্য সমাধান! ইন্সপেক্টর অবশ্য রোদের ব্যাপারে আগে শুনেছিলেন, তাই অবিশ্বাস করতে পারলেন না। রোদ পুলিশের জীপ বের করতে বললো। সবাি মিলে জিপে চড়ার পর রোদ বললোঃ সাকিবের বাড়িতে চলুন। সেখানেই হবে যবনিকা পতন। অফিসার এবং রোদ বাসায় গিয়ে নক করলো। আগের মতোই দরজা খুললো তাহমিদ। স্বাভাবিকভাবেই জানতে চাইলোঃ - এইতো কিছুক্ষন আগে গেলেন আবার কেন আসছেন? -সরি টু সে মিস্টার তাহমিদ, আপনার কাঁচা ক্রাইম ধরা পড়ে গিয়েছে। এবার আগের মতো উত্তেজিত হল না তাহমিদ। শান্ত মুখে বাঁকা হাসি দিয়ে প্রশ্ন করলঃ -আমিই যে অপরাধ করেছি তার কোনো প্রমান দেখান আগে। -ওইযে দেখুন টেবিলে কয়েকটা সেন্টার ফ্রুট। আপনি ছাড়া এ বাসায় কেউই সেন্টার ফ্রুট খায় না আশাকরি। আমি খুনের স্পটে সেন্টার ফ্রুটের খোসা পেয়েছি। -সেন্টার ফ্রুট যে শুধু আমিই খাই একথাটা ভিত্তিহীন। ভাইয়াইও তো খেতে পারে রাইট? -পোস্টমর্টেম রিপোর্টে আপনার ভাইয়ার পেটে সেন্টার ফ্রুটের রস পাওয়া যায়নি। তাছাড়া আমি গতবার এসেও আপনার মুখে সেন্টার ফ্রুট দেখেছি। আপনিই আপনার ভাইকে খুন করতে গিয়ে ভুলবশত সেন্টার ফ্রুটের খোসা ফেলে আসছেন। -এটুকে প্রমান হয় না ওখানে আমিই ছিলাম। হয়তো অন্য কোনো মানুষ যে সেন্টার ফ্রুট খায় সে খুনটা করেছে। -তাহলে এবার শুনুন। আপনার খাওয়াদাওয়ার অভ্যাসই আপনার প্রধান শত্রু। আপনি গত পরশু বিকালে শুধু সেন্টার ফ্রুটই খাননি খেয়েছিলেন একটি আইসক্রিমও। সেই আইসক্রিম দিয়েই খুন করেছেন আপনার ভাইকে। রোদের একথার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিল না তাহমিদ। বিস্ফোরিত চোখে রোদের দিয়ে একবার তাকিয়ে সে দৌড় দেয় বাহিরের দিকে। ইন্সপেক্টর এবার তার দায়িত্ব বুঝে নেন। লাফ দিয়ে ধরে ফেলেন তাহমিদকে। ধরা পড়া তাহমিদ ততক্ষণে কাঁদতে শুরু করেছে। রোদ আবার তার জেরায় ফিরে গেলো, "তার মানে সত্যিই সম্পত্তির লোভে আপনি খুনটা করেছেন?" -জ্বি আপনার ধারনাই ঠিক। আমার ভাই ভালো চাকরি করে, মায়ের সব কথাও শোনে। তাই মা সমস্ত সম্পত্তি ওর নামে লিখে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি কি এতোই ফেলনা? ওর তো এমনিতেই আয়ের উৎস আছে সম্পত্তি দিয়ে কি করবে? সম্পত্তির আসল দরকার আমার, আমি তো আর চাকরি করি না। কিন্তু মদ-সিগারেট খেতে টাকা তো আমার ঠিকই দরকার। আমাকে না দিয়ে তেলা মাথায় তেল দেওয়ার মতো ভাইয়াকে সব সম্পত্তি দিতে যাচ্ছিলো মা। তাই আমি ভাইয়াকে গোপনে ওই পোড়োবাড়িতে ডাকি। কারন বাসায় এসব আলোচনা আমাদের মা একদম সহ্য করতেন না। আমার রুম ভিতর থেকে লক করে জানালা দিয়ে পালিয়ে আমিও পোড়াবাড়িটায় যাই। ভাইয়াকে আমি আমার টাকার প্রয়োজন এবং উত্তরাধিকার বুঝাচ্ছিলাম আর আইসক্রিম খাচ্ছিলাম। খেতে খেতে আইসক্রিমের মাথাটা সরু হয়ে যায়। একপর্যায়ে ভাইয়া আমার সাথে তুমুল ঝগড়া শুরু করে। ও মানতেই চাচ্ছিলো না সম্পত্তিতে আমার সমান অধিকার। বুঝতেও পারছিলো না আমার টাকার কতো প্রয়োজন। তাই মেজাজ গরম করে আইসক্রিমটা ওর পেটে চালিয়ে দেই। সাথে সাথে প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় ভয়ে পালিয়ে আসি। ভাইয়াকে মারার উদ্দেশ্য আমার ছিল না। রাগের মাথায় একটা ভুল করে ফেলেছি। এখন আমি অনুতপ্ত। রোদ বললো, "রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তার মূল্যও দিতে হয়। মদ-সিগারেটের নেশা বাদ দিয়ে যদি চাকরি জোগাড় করতে পারতেন ভাইয়ের মতো, তাহলে তো আপনাকে নিশ্চয়ই সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হতো না। আপনাকে ভালো পথে আনার জন্যই আপনার মা-ভাই বঞ্চিত করার ভয় দেখিয়েছিল যেন আপনি মদ-সিগারেট বাদ দিতে পারেন। কিন্তু আপনি তো তা বুঝলেনই না, উল্টো করে বসলেন অপরাধ। এবার আপনাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার বাকি দায়িত্বটুকু ইনস্পেকটরের। বিদায়, ভালো থাকবেন।"

কিডন্যাপ

নিবিরের ফোনটা টুং করে বেজে উঠলো। রাত্রি মেসেজ দিয়েছে। মেয়েটা সারাদিন মেসেজ করতেই থাকে। ওর মনের মধ্যে এতো কথা কিভাবে আসে তা নিবির ভেবে পায় না। নিবিরও রাত্রিকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু সেটা প্রকাশ করে কম। মনের ভালোবাসা মনেই লুকিয়ে রাখে। অন্যের কাছ থেকে লুকাতে পারলেও রাত্রি ঠিকই বুঝে যায় কতোটা ভালোবাসে নিবির। ওদের সম্পর্ক আর কয়েকমাস পর চারবছরের হবে। এতোদিন হলেও কারো প্রতি কারো টান এতোটুকুও কমেনি। কথা বলতে বলতে মাঝেমধ্যেই প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি মনে উঁকি দেয়। এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে মুখে। আপাতত রাত্রি মেসেজে শুধু দেখা করার কথা লিখেছে। বিকালে পার্কে আসতে হবে নিবিরের। ভার্সিটির পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে একদিন দুদিন পরপরই দেখা করে ওরা। নিবিরের দেখা পেলেই রাত্রির মুখে হাসি যেনো আর ধরে না। নিবিরও চায় এই হাসি আজীবন বজায় থাকুক। মেসেজের রিপ্লাইয়ে সম্মতি জানিয়ে আবার পড়ালেখা শুরু করলো নিবির। রাত্রি উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে। ছোটবেলায় থেকেই আদরের ঘরের দুলালীর মতো বড় হয়েছে সে। তবে অন্য ধনী মেয়েদের মতো সে গরীবদের ঘৃণা করতো না। সবাইকে সাহায্য করতো পড়ালেখায়। এভাবেই কলেজে পরিচয় ঘটে নিবিরের সাথে আর প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। রাত্রি পার্কে এসে বসে আছে নিবিরের অপেক্ষায়। মেজাজ খারাপ হওয়া শুরু হতে না হতেই নিবির এসে হাজির। ততক্ষণে রাত্রি স্বভাবসুলভ চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। নিবির ওদিকে রাগ ভাঙাতে ব্যস্ত! -প্রতিবার লেট করে আসো তুমি। তোমার এই বদঅভ্যেস ঠিক হবে কবে? -রাগ করো না লক্ষীটি, রাস্তায় জ্যাম ছিলো। তুমিই বলো, আমি কি ইচ্ছে করে লেট করি?আমারো তো ইচ্ছে করে রাত্রিরাণীকে এক পলক দেখতে! -এক পলক না এবার মনভরে দেখো। -তুমি তো লজ্জায় লাল হয়ে যাবা তখন কি হবে? -কিচ্ছু হবে না, তোমার চোখে আমার চোখ পড়বে, হারিয়ে যাবো মুগ্ধতায়! -আবার মনে হয় রোমান্টিক উপন্যাস পড়ে আসছো। -ধ্যাৎ! তুমি না একটা যা তা, আনরোমান্টিক বদ লোক। -আচ্ছা অভিমান করো না আর। চলো ফুসকা খেয়ে আসি। নির্জন রাস্তা দিয়ে হাটছে নিবির আর রাত্রি। হঠাৎ একটা মাইক্রো এসে থামলো। সাথে সাথে দরজা খুলে দুটো লোক বেরিয়ে এসে প্রথমে ধাক্কা দিলো নিবিরকে। এরপর চোখের পলকে রাত্রিকে গাড়িতে উঠিয়ে পালায়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল নিবির কিছুক্ষণ চিৎকার করে রাত্রিকে ডাকলো। একটু পর হুশ ফিরে এলে নিবির মনস্থ করে রাত্রিকে সে উদ্ধার করবে। প্রথমেই নিবির রাত্রিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার জায়গাটা নিরীক্ষণ করতে থাকে। একটু চোখ বুলাতেই একটা ভিজিটিং কার্ড খুজে পায় নিবির। সম্ভবত টানাটানির সময় দুটো লোকের কারো পকেট থেকে পড়েছে। নিবির ভিজিটিং কার্ডটা পকেটে পুরে পুলিশ স্টেশনে রওনা দেয়। মাঝপথে ফোন করে রাত্রির ভাইকে খবরটা দিতেও ভুলেনি নিবির। পুলিশের উপর ভরসা নেই নিবিরের। তাই জিডির পরে সে নিজেই আইডি কার্ডের দেয়া ঠিকানায় উপস্থিত হয়। কলিং বেল বাজানোর পর একজন মাঝবয়সী লোক দরজা খুলে। -কাকে চাই? -এই ভিজিটিং কার্ডের মালিক কি এই বাসার? -হ্যা, এটাই উনার বাসা। আপনি কে? -ওনার সাথে আমার একটু কথা ছিলো। -উনি এখন বাসায় নেই। পরবর্তীতে ওনার অনুমতি নিয়ে আবার আসবেন। লোকটা মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে নিবির। আচ্ছা বেয়াদব লোক তো! কিন্তু এতো সহজে হার মানলে তো চলবে না। বাড়ির পিছনের দিকে চলে যায় সে। একটা পাইপ নজরে আসে। এই পাইপই এখন সম্বল, এটা বেয়েই উপরে উঠতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। পাইপ বেয়ে বেয়ে কোনরকমে ছাদে উঠে পড়লো নিবির। এবার সাবধানে রুমগুলো খুঁজতে হবে। চুপিচুপি হেঁটে একটা রুমের সামনে দাঁড়ায়। রুমের ভেতরে কিছু লোকের কথা বোঝা যাচ্ছে। দরজার ফুটো দিয়ে তাকায় নিবির। আরে ওইতো একটা লোক যে রাত্রিকে নিয়ে গিয়েছিলো! কিন্তু আরেকটা লোক কই, আর রাত্রিই বা কোথায়? ওদের কথাগুলো আগে শোনা দরকার নিবিরের। -মেয়েটাকে কোথায় রেখোছো? -চিলেকোঠায়, স্যার। -খাবার-দাবার কিছু দিও, কেমন?বড়লোকের মেয়ে তো, ওর বাপের কাছ থেকে বড় এমাউন্টই পাবো। একটু খাওয়াতেই পারি আমরা। -আচ্ছা স্যার, বার্গার নাহলে স্যান্ডউইচ দিবোনে ওকে। -আর শোনো, ফেক সিম জোগাড় করেছো তো? -জোগাড় হয়ে গেছে, এখন আপনি কল দিলেই টাকা আর টাকা। -কালকে দিবোনে কল। মেয়ের হারিয়ে যাওয়াটা নিশ্চিত হোক। -তাহলে স্যার আজ আমরা আসি। -হ্যা, আসো। দ্রুত দরজা থেকে সরে কোণায় লুকিয়ে পড়ে নিবির। সন্ধ্যার আবছা আলোয় কোণায় লুকিয়ে থাকা নিবিরকে চোখে পড়েনি কারো। এখন নিবিরকে খুঁজে নিতে হবে রাত্রি কোথায়, কোন চিলেকোঠায়। আগে এই বিল্ডিংয়ের চিলেকোঠাটা দেখা যাক। ধীরে ধীরে হেঁটে বিল্ডিংটার চিলেকোঠা খুঁজতে থাকে নিবির। কিন্তু কোথাও চিলেকোঠার নামগন্ধ নেই। তবে কি রাত্রি অন্য কোনো বিল্ডিংয়ে, দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নিবিরের বুক চিড়ে। এতো কষ্ট করে বিল্ডিংয়ে এসেও লাভ হলো না, রাত্রিই নেই। তখনই নিবিরের মনে পড়ে ওই লোকটার রুমে কিছু থাকতে পারে, কিন্তু লোকটা তো এখনো রুমের ভেতর। আগে ওরে বের করতে হবে। ভিজিটিং কার্ডটা আবার বের করে নিবির। ওখান থেকে নাম্বারটায় কল দেয়। -হ্যালো, কে বলছেন? -আমায় চিনবেন না। আপনার সাথে একটু কথা ছিলো। একটু নিচতলায় আসুন। -আচ্ছা। লোকটা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। অমনি রুমে ঢুকে পড়লো নিবির। যা করার, তাড়াতাড়ি করতে হবে। রুমে অনেকগুলো কাগজপত্র। চোখ বুলাতে বুলাতে হঠাৎ চোখ পড়ে একটা নকশায়। আন্ডারগ্রাউন্ড রুমের নকশা। তবে কি এই বিল্ডিংয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড রুম আছে?রাত্রি কি ওখানেই? আন্ডারগ্রাউন্ড রুমের নাম কি কেউ চিলেকোঠা দেয়? এখনি চেক করা দরকার। দ্রুত কাগজগুলো জায়গামতো রেখে বের হয়ে এলো নিবির। নকশাটা মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছে ও। সিড়ি শেষ করে সিড়ির নিচে দেখে একটা আলমারি। ওই আলমারির ভিতরে আছে আন্ডারগ্রাউন্ডের দরজা। আলমারির পর দরজা খুলে আবার একটা সিড়ি পেলো নিবির, ঠিক যেমনটা নকশায় আছে। সিড়ি দিয়ে কিছুদূর নামার পর নিবির একটা রুম পায়, ভিতরে শব্দ শোনা যাচ্ছে। দরজার সামনে দাড়াতে দাড়াতেই দরজা খুলে যায়, কিন্তু এবার তো লুকানোর জায়গা নেই! দরজা খোলা লোকটাকে চিনতে পারে নিবির, রাত্রিকে কিডন্যাপের দ্বিতীয় লোকটা। কোনোরকম চিন্তাভাবনা ছাড়াই লোকটার কাঁধে আঘাত করে বসে নিবির। উপর্যুপরি আঘাতে তখনই সে অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর রুমের ভেতরে ঢুকেই দেখে রাত্রি চেয়ারে বাঁধা। শব্দের জন্য দরজার জন্য তাকিয়েছিলো। নিবিরকে দেখে খুশিতে কেঁদে দেয় রাত্রি। -আমি জানতাম তুমি আসবে। আর কেউ না আসলেও ঠিকই তুমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসেছো আমায় বাঁচাতে। -তোমার জন্য সবরকম ঝুঁকি নিতে পারি আমি। পরম মমতায় রাত্রির চোখ মুছে দেয় নিবির।হাতের বাঁধন খোলার পর রাত্রি জড়িয়ে ধরে নিবিরকে। তখনই দরজা দিয়ে খাবার হাতে ঢুকে পড়ে প্রথম কিডন্যাপার। তীরে এসে কি তরী ডুববে নাকি! লোকটা সম্ভবত অজ্ঞান করার স্প্রে বের করছে। ফ্লাইং কিক দিলো নিবির। স্প্রে টা উড়ে গিয়ে পড়লো কোণায়। স্প্রেটার দিকে এগোতে লাগলো লোকটা, এই ফাঁকে পাশের থেকে একটা রড দিয়ে লোকটাতে মেরে দিলো রাত্রি। এরপর নিবিরের হাত ধরে দৌড়। যে পথে নিবির এসেছিলো সেই পথেই রাত্রিকে নিয়ে বের হয়ে এলো বাসার বাইরে। -এভাবেই সবসময় আমাকে সমস্ত বিপদ থেকে বাঁচাবে তো? -সারাজীবন আগলে রাখবো তোমায়! সবসময় হাসি ফুটিয়ে তুলবো তোমার মুখে!
Go to top